কুমিল্লা জেলার জনপ্রিয় ১৩টি দর্শনীয় স্থান

কুমিল্লা জেলা একটি ইতিহাস ও ঐতিহ্যের শহর। তাই কুমিল্লা জেলার জনপ্রিয় ১৩টি দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে আমাদের জানা উচিত।
মূলত পাল বংশের শাসনামলেই শালবন বৌদ্ধ বিহার, আনন্দ বিহার, ময়নামতি, ধর্মসাগর সহ আরও নানা স্থাপত্য ও ঐতিহ্যের নিদর্শন তৈরি হয় কুমিলা জেলায়। ফলে কুমিল্লা জেলার জনপ্রিয় ১৩টি দর্শনীয় স্থান গুলি কি কি তা জানতে নিচের বর্ণনাটি পড়তে হবে।

পোস্ট সূচিপত্র: কুমিল্লা জেলার জনপ্রিয় ১৩টি দর্শনীয় স্থান (13 Popular Tourist Attractions in Comilla district)

কুমিল্লা জেলার জনপ্রিয় ১৩টি দর্শনীয় স্থান - শেষকথা 

শালবন বৌদ্ধ বিহার

কুমিল্লা জেলার জনপ্রিয় ১৩টি দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে শালবন বৌদ্ধ বিহার অন্যতম। শালবন বৌদ্ধ বিহারটি কুমিল্লা জেলার কোটাবাড়িতে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থান। বলা যায়, বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের প্রধান উপসনালয় হচ্ছে এই বৌদ্ধ বিহার। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী অনুসারীদের ধর্মচর্চা হিসেবে খ্যাত এই বিহারে ১৫৫টি কক্ষ আছে। উল্লেখ্য এই স্থানে অসংখ্য শাল গাছ থাকায় এর নামকরণ হয়েছে শালবন বৌদ্ধ বিহার। প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ এই স্থান হতে প্রায় ৪০০টি স্বর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রা, ব্রোঞ্জ ও মাটির মূর্তিসমূহ, অসংখ্য পোড়া মাটির ফলক, তাম্রলিপি এবং বৌদ্ধদের শাসনকার্য পরিচালনার সিলমোহর।

ময়নামতি জাদুঘর

ময়নামতি জাদুঘরটি ১৯৬৫ সালে কোটবাড়ির শালবন বিহারের পার্শ্বেই স্থাপন করা হয়। ভোজ রাজবাড়ী বিহার, ইটাখোলা, রানির বাংলা, শ্রীভবদের মহাবিহার, কোটিলা মুড়া, রূপবান,কুমিল্লার চারপত্র ও আনন্দ বিহার খনন করলে অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিস্কার হয়। কুমিল্লা জেলার জনপ্রিয় ১৩টি দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে অবশ্যই ময়নামতি জাদুঘর পরিদর্শন করতে হবে, কেননা ময়মামতি জাদুঘরটি ঐতিহাসিক নিদর্শনের এক গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রহশালা। এই জাদুঘরে রয়েছে ৪২টি সংরক্ষণাগার, যা ঘুরে দেখার সময় চোখে পড়বে নানারকম ব্রোঞ্জ এবং পাথরের বিভিন্ন আকৃতির মূর্তি, ব্রোঞ্জের বিশাল ঘন্টা, মাটির খেলনা, কাঠের পুরনো জিনিসপত্র, স্বর্ণ ও রৌপ্যের বিভিন্ন মুদ্রা, বিভিন্ন মৃৎশিল্প সামগ্রী, পোড়ামাটির সুন্দর কারুকার্য নানারকম ফলকসহ সর্বোপরি প্রাচীন হাতে লেখা পান্ডুলিপিসমূহ।

আরও পড়ুন: বিশ্বের সবচেয়ে শীর্ষ ১০টি বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান

ধর্মসাগর দিঘী

কুমিল্লা জেলার জনপ্রিয় ১৩টি দর্শনীয় স্থান এর মধ্যে ইতিহাস ও ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ ধর্মসাগর দিঘী। ইতিহাস অনুযায়ী তৎকালীন রাজা ধর্মপাল প্রজাদের জলের কষ্ট দূর করার জন্য খ্রীষ্টপূর্ব ১৭৫০-১৮০৮ দশকের কোন এক সময় খনন করেন এই ধর্মসাগর দিঘীটি। এই দিঘীর উত্তরে রয়েছে শিশুপার্ক এবং এই শিশুপার্ক থেকে ধর্মসাগরের অপরূপ দৃশ্য উপভোগ করা যায়। বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পর্যটকগণ আসেন কুমিল্লা জেলায় শুধুমাত্র ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো পরিদর্শনের জন্য। পর্যটকদের মধ্যে অনেকে ধর্মসাগরের পাড় ধরে হেটে বেড়িয়ে এর সৌন্দর্য উপভোগ করেন আবার কেউবা নৌকা নিয়ে ভেসে বেড়ান দিঘীর জলে।

নব শালবন বিহার

নব শালবন বিহারের উদ্দেশ্য হলো এটি পরে নির্মিত হয়। অর্থাৎ ১৯৯৫ সালের ৮ সেপ্টেম্বর বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য শান্তি বিহার নামে পরিচিত এই নব শালবন বিহার প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০১৪ সালে থাইল্যান্ডের বৌদ্ধ ধর্মীয় ফাউন্ডেশন এর পক্ষ থকে ৬ টন ওজনের এবং ৩০ ফুট চওড়া একটি বুদ্ধদেবের মূর্তি বাংলাদেশকে উপহার দেন, যা এখানকার মূল আকর্ষণ।

ইটাখোলা মুড়া

সপ্তম বা অষ্টম শতকের কোন এক সময়ে নির্মাণ করা হয় ইটাখোলা মুড়া নামে এই বৌদ্ধ বিহারটি। এই জায়গার ইতিহাস বলতে, প্রাচীনকাল হতে এখানে ইট পোড়ানো হত বলে জায়গাটির নামকরণই হয়ে গেছে ইটাখোলা মুড়া। প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ থেকে ইটাখোলা মুড়া খননকালে যেসব জিনিস পাওয়া গেছে, তা হলো-রৌপ্য মুদ্রা, মাটির পাতিলে রক্ষিত সোনার বল, ধ্যানী বুদ্ধ মূর্তির আবক্ষ, ১৮ তোলা ওজনের স্বর্ণ, ধাতব ধ্যানীবুদ্ধ অক্ষোভ্য, গণেশ মূর্তি, তাম্রশাসন, ধাতব ধ্যানী বুদ্ধ অমিতাভ, তেলের প্রদীপ ইত্যাদি সামগ্রী।

আনন্দ বিহার

তথাকথিত সপ্তম বা অষ্টম শতকে দেব রাজবংশের তৃতীয় শাসক শ্রী আনন্দ দেব উপমহাদেশে সর্বশেষ বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে এই আনন্দ বিহার নির্মাণ করেন। উল্লেখ্য যে, তৎকালীন সময়ে এই আনন্দ বিহার ছিল সমতটের রাজধানী।

ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি

ময়নামতি ওয়ার সিমেট্রি ময়নামতি সাহেব বাজার এবং কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টের টিপরা বাজারের মধ্যস্থলে অবস্থিত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শহীদ হওয়া ব্রিগেডিয়ার পদমর্যাদার সৈন্যদের  একটি সমাধি ক্ষেত্র হচ্চে এই ময়নামতি ওয়ার সিমেটট্রি। এই সমাধে ক্ষেত্রে রয়েছে ৭৩৭ জন সৈনিকের কবর।

রূপবান মুড়া

ধারণা করা হয় খ্রীষ্টপূর্ব সপ্তম থেকে ১২শ শতাব্দীতে নির্মিত হয়েছিল এই রূপবান মুড়া স্থানটি। ইতিহাস অনুযায়ী রহিম ও রূপবানের ভালোবাসার কিংবদন্তির সাক্ষী হিসেবে এই ঐতিহাসিক স্থানটি। এই স্থানটি ইটাখোলা মুড়ার ঠিক উল্টো পাশে অবস্থিত। ইতিহাস ও ঐতিহ্য জানার আগ্রহে পর্যটকগণ এই রূপবান মুড়ার উঁচু বিহারের উপর থেকে সূর্যাস্তের মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখে থাকেন।

রানি ময়নামতির প্রাসাদ

ধারণা করা হয়, অষ্টম থেকে দ্বাদশ শতাব্দীর কোন এক সময়ে চন্দ্র বংশের রাজা মানিক চন্দ্র তার স্ত্রী ময়নামতির আরাম আয়েশের জন্য এই ময়নামতির প্রাসাদ নির্মাণ করেছিলেন। ১৯৮৮ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক বিভাগ কর্তৃক ভূ-পৃষ্ঠ হতে মাত্র ৩ মিটার গভীরে থাকা একটি সুড়ঙ্গটি খননের সময় আবিস্কৃত হয় এই প্রাসাদটি। এখানে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা প্রতি বৈশাকের সপ্তম দিন থেকে মাসব্যাপী বৈশাখী মেলার আয়োজন করে থাকেন।

ম্যাজিক প্যারাডাইস পার্ক

ম্যাজিক প্যারাডাইস পার্কটি কুমিল্লা জেলার কোটবাড়ি এলাকায় অবস্থিত একটি বিনোদন কেন্দ্র। এই পার্কটিতে ২০টিরও অধিক রাইড, ডাইনোসর পার্ক, ওয়াটার পার্ট, পিকনিক স্পটসহ নানাবিধ বিনোদন কেন্দ্র সম্বলিত সবচেয়ে সুন্দর একটি এমিউজমেন্ট পার্ক।

আরও পড়ুন: কবিদের ভাবনায় বর্ষাকাল - বাংলা কবিতায় বর্ষাকাল

ফান টাউন পার্ক

২০১৬ সালে কুমিল্লা জেলার ঢুলিপাড়াতে সম্পূন্ন বেসরকারী উদ্যোগে তৈরীকৃত একটি সুবৃহৎ বিনোদন কেন্দ্র ভার্চুয়াল ফান-টাউন। বাচ্চাদের জন্য এটি অত্যান্ত আকর্ষণীয় এবং মজাদার ভার্চুয়াল থীম পার্ক ফান-টাউন।

ডাইনো পার্ক

কুমিল্লা জেলার কোটবাড়ির জামমূড়ায় লালমাই পাহাড়ের প্রায় ১২ একর বিস্তৃত জায়গার উপরে এই ডাইনো পার্কটি নিমাণ করা হয়েছে। এটি বাংলাদেশের একমাত্র ডাইনোসর পার্ক হিসেবেও সমধিক পরিচিত।

জাহাপুর জমিদার বাড়ি

ঐতিহ্য ও ইতিহাসের সাক্ষ্য হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে জাহাপুর জমিদার বাড়িটি, যা ১৮৬২ শতকে তদানিন্তন জমিদার নির্মাণ করেছিলেন। এই জমিদার বাড়িটি কুমিল্লা জেলার মুরাদ নগরে অবস্থিত। শান্ত, নিরিবিলি ছাড়াও সকল জমিদারদের নাম জমিদার বাড়ির শ্মশানে অর্থাৎ সমাধিতে দেখতে পাওয়া যায়।

অন্যান্য দর্শনীয় স্থানসমূহ:

কুমিল্লা জেলার জনপ্রিয় ১৩টি দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে জানার পরেও আরও কিছু দর্শনীয় স্থান রয়েছে, যা নিম্নরূপ:
শাহ সুজা মসজিদ
বীরচন্দ্র গণপাঠাগার ও নগর মিলনায়তন
উটখাড়া মাজার
বায়তুল আজগর জামে মসজিদ
নূর মানিকচর জামে মসজিদ
কবি তীর্থ দৌলতপুর (জাতীয় কবি কাজী নজরুলের স্মৃতি বিজড়িত স্থান)
গোমতী নদী
নওয়াব ফয়জুন্নেছার স্বামী গাজী চৌধুরীর বাড়ী সংলগ্ন মসজিদ

কুমিল্লা জেলার জনপ্রিয় ১৩টি দর্শনীয় স্থান-শেষকথা:

ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে রয়েছে নানাবিধ ঐতিহাসিক স্থান, বিভিন্ন স্থাপনাকৃতি, পাহাড়-পর্বত, সমুদ্র, প্রাকৃতিক নৈসর্গ্য সহ নানাবিধ স্থাপনা আজও বহমান ইতিহাসের হাত ধরে। বাংলাদেশ ঠিক তেমনই একটি দেশ, যেখানে আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে নানাবিধ ঐতিহাসিক স্থাপনা, নিদর্শন, দর্শনীয় স্থানসমূহ। কুমিল্লা জেলাটি ঠিক তেমনই একটি ঐতিহাসিক বা ইতিহাসের সাক্ষ্য বহমান স্থান, যেখানে আজকের আলোচনায় কুমিল্লা জেলার জনপ্রিয় ১৩টি দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে আশাকরি আপনাদের জানাতে পেরেছি।

আরও পড়ুন: বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নাম, রাজধানী ও মুদ্রার নামসমূহ 

আমাদের কুমিল্লা জেলার জনপ্রিয় ১৩টি দর্শনীয় স্থান সম্পর্কিত আর্টিকেলটি যদি ভালো লাগে তাহলে তা অন্যদের সাথে শেয়ার করতে পারেন। মূলত একসময় এ অঞ্চলে বিভিন্ন রাজা-বাদশাহ, জমিদার, নায়েব, কাচারী, ইত্যাদি নানা জায়গাগুলি পরিচালিত হতো রাজা-বাদশাহের আদেশে। কুমিল্লা জেলার জনপ্রিয় ১৩টি দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে বলতে গেলে পাল বংশের রাজত্বকালে এ অঞ্চলে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের আর্বিভাব ঘটে। যার উদাহরণ হলো কুমিল্লার জেলার শালবন বৌদ্ধবিহার, আনন্দ বিহার, ময়নামতি, ধর্মসাগর সহ অসংখ্য নিদর্শন। 
পরিশেষে কুমিল্লা জেলার জনপ্রিয় ১৩টি দর্শনীয় স্থান বিষয়ক আলোচনায় আমাদের সাথে থাকার জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url