বীরকন্যা প্রীতিলতার ৯৩ তম আত্মহুতি দিবস আজ

ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম বিপ্লবী এবং প্রথম নারী শহীদ বীরকন্যা প্রীতিলতার ৯৩ তম আত্মহুতি দিবস আজ।
বীরকন্যা-প্রীতিলতার-৯৩-তম-আত্মহুতি-দিবস-আজ
অর্থাৎ ১৯৩২ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণের নেতৃত্ব দেন মাস্টারদা সূর্য সেন’র অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধা হিসেবে খ্যাত প্রীতিলতা।

পোস্ট সূচিপত্র: বীরকন্যা প্রীতিলতার ৯৩ তম আত্মহুতি দিবস আজ (Today is the 93rd suicide anniversary of Heroic Daughter Pritilata)
বীরকন্যা প্রীতিলতার আত্মহুতি দিবসের প্রেক্ষাপট
প্রীতিলতার জন্মতথ্য এবং শিক্ষা জীবন
মায়ের প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসা
আজও স্মৃতিতে অম্লান প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার
বীরকন্যা প্রীতিলতার ৯৩ তম আত্মহুতি দিবস আজ-পরিশেষে

বীরকন্যা প্রীতিলতার আত্মহুতি দিবসের প্রেক্ষাপট:

মূলত বীরকন্যা প্রীতিলতার ৯৩ তম আত্মহুতি দিবস আজ অর্থাৎ ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর, কিন্তু তারপরেও প্রীতিলতার আত্মহুতি দিবস হিসেবে পালন করা হয় ২৪ সেপ্টেম্বর। তথাকথিত ব্রিটিশদের হাত থেকে দেশকে স্বাধীন করার লক্ষ্যে মাস্টারদা সূর্য সেন’র নেতৃত্বে নানা স্থানে বিপ্লবী সংগঠনগুলি ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে সংযুক্ত ছিল। প্রীতিলতা মাষ্টারদা সূর্য সেন’র ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে এ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন।

আরও পড়ুন: বই পড়ার উপকারিতা - আমাদের কেন বই পড়তে হবে? - বই পড়ার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা

সেই সময়ে চট্টগ্রামে দুটি ইউরোপিয়ান ক্লাব ছিল। একটি শহরের কেন্দ্রে এবং অপরটি একটু বাইরে অর্থাৎ পাহাড়তলিতে। বিপ্লবীদের ১৮ এপ্রিল ১৯৩০ সালে প্রথম আক্রমণের লক্ষ্য ছিল পল্টন ময়দানের ইউরোপিয়া ক্লাবটি, কিন্তু তা ব্যর্থ হয়ে যায়। এরপর ১০ আগষ্ট ১৯৩২ সালে শৈলশ্বর দে’র নেতৃত্বে পাহাড়তলী ইউরোপিয়ান ক্লাবটি আক্রমণের সিদ্ধান্ত হয়, কিন্তু এই অভিযানটিও ব্যর্থ হয়ে যায়। পরবর্তীতে মাষ্টারদা সূর্য সেন’র নিকট খবর আসে যে, ২৩ সেপ্টেম্বর পাহাড়তলী ক্লাবে আবারও ইংরেজরা একত্রিত হবেন এবং সেই সুবাদে জলসা অনুষ্ঠিত হয়। মাষ্টারদা সুর্যসেনের নারীদল অনেকদিন থেকেই এই ধরনের আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার অনুরোধ জানিয়ে আসছিল। অতঃপর মাষ্টারদা প্রীতিলতার হাতে এ দায়িত্ব ন্যস্ত করেন। সিদ্ধান্ত হয়, ২৩ সেপ্টেম্বর পাহাড়তলীর সেই ইউরোপিয়ান ক্লাবটি আক্রমণ করা হবে। প্রীতিলতা থাকবেন মূল নেতৃত্বে এবং তাঁর সাথে সহযোগি হিসেবে থাকবেন শান্তি চক্রবর্তী, কালী দে, প্রফুল্ল দাস, সুশীল দে, মহেন্দ্র চৌধুরী, বীরেশ্বর রায় এবং পান্না সেন।

আসলে বীরকন্যা প্রীতিলতার ৯৩ তম আত্মহুতি দিবস আজ হিসেবে দিনটি ছিল ১৯৩২ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর, শনিবার। বিপ্লবীরা সবাই প্রস্তুত। প্রীতিলতার পরনে ছিল পুরুষদের মতো করে মালকোচা দেয়া ধুতি, মাথায় গৈরিক পাগড়ি, গায়ে লাল ব্যাজ লাগানো শার্ট, পায়ে ছিল মোজা ও বাদামি রঙের ক্যানভাসের রাবার সোলের জুতো। যাইহোক সবাই রেডি হয়ে সর্বাধিনায়খ সূর্য সেনের নিকট থেকে বিদায় নিয়ে এই বিপ্লবী অভিযাত্রী দল আক্রমনের জন্য যাত্রা করল। রাত আনুমানিক ১০টা ৪৫ মিনিট। সবাই সবার নিজ নিজ অবস্থানে থেকে সংকেতের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। অপেক্ষার প্রহর শেষে তিনদিক থেকে শুরু হয়ে গেল আক্রমণ। প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরিত হলো পিকরিক অ্যাসিডে ভরা একটি বোমা। প্রীতিলতা, কালি দে ও শান্তি চক্রবর্তী ওয়েবলি রিভলবার, বোমা, তরবারি নিয়ে হলঘরের সামনের দারজার দিকে ঝাঁপিয়ে পড়েন। মদ্যপ সাহেব ও মেমদের আর্তনাদে এক বিভীষিকাময় হয়ে উঠল সে রাত্রের প্রমোদ ক্লাবটি। এর মধ্যে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে ঘন অন্ধকারে ডুবে যায় সমস্ত স্থানটি। বিপ্লবী কমান্ডোরা ক্লাব পরিত্যাগ করার সময় বিলম্বে বিস্ফোরিত হওয়ার জন্য তিনটি বোমা রেখে যান। যাইহোক প্রীতিলতা তার ওপরে ন্যস্ত অধিকায়কের দায়িত্ব সফল ভাবে সম্পন্ন করে হুইসেল বাজিয়ে তিনি সবাইকে প্রত্যাবর্তনের নির্দেশ দেন। সামরিক নিয়ম অনুযায়ী, অভিযানের সময় নেতা সবসময় সবার আগে থাকবেন এবং অভিযান শেষে তিনি সবাইকে নিরাপদে পাঠিয়ে পেছনে আসবেন। সুতরাং সেই নিয়মানুযায়ী প্রীতিলতা বিজয়িনীর বেশে ক্লাবের সানে রেলের বড় সড়কে চলে আসেন।

কিন্তু আক্রমনের সময় অনেক ইংরেজ বিভিন্ন দরজা দিয়ে পালিয়ে যান। ঠিক তেমনই এক ইংরেজ যুবক নিজের আত্মরক্ষার জন্য ক্লাবের পাশের এক নালার মধ্যে লম্বা হয়ে শুয়ে আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হন। তিনি সেই নালায় থেকে দেখতে পান যে, বিপ্লবীরা সবাই একে একে ফিরে যাচ্ছেন এবং সবার পেছনে পাগড়ি মাথায় সামরিক পোশাকে সজ্জিত একজন একা একা রাস্তা পার হচ্ছেন পাহাড়তলী রেলওয়ে কারখানার উত্তরদিকে। ঠিক এ সময় নালার মধ্য থেকে একটি বুলেট এসে প্রীতিলতার বুকে আঘাত হানে এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁর রক্তাক্ত দেহ মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। প্রীতিলতা সাথীদের নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছে দিয়ে নিজেও প্রায় পাঁচশত গত এগিয়ে গিয়েছিলেন, কিন্তু শেষ রক্ষা আর হলো না। তাঁর পক্ষে আর নিরাপদ আশ্রয়ে পৌঁছানো সম্ভব না জেনে এবং পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সহযোদ্ধা কালীকিংকর দে’র হাতে নিজের আগ্নেয়াস্ত্রটি জমা দিয়ে বললেন, কালীদা, আপনার সায়ানাইডটুকু আমাকে দিন, আমারটুকু আমি খেয়ে নিয়েছি। এরপর তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়েন এবং শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

আরও পড়ুন: পার্বত্য চট্টগ্রামের যত দর্শনীয় স্থান ও নামসমূহ

পরবর্তীতে পুলিশ ১০০ গজ দূরে প্রীতিলতার মরদেহ খুঁজে পায় এবং তাঁর দেহ তল্লাশী করে বিপ্লবী লিফলেট, অপারেশনের পরিকল্পনা, রিভলভারের গুলি, রামকৃষ্ণ বিশ্বাসের ছবি এবং একটি হুইসেল পান। ময়নাতদন্তে জানা যায় যে, তাঁর গুলির আঘাতটি তেমন গুরুতর ছিল না, বরং পটাসিয়াম সায়ানাইড খাওয়াই ছিল তাঁর মৃত্যুর কারণ।

প্রীতিলতার জন্মতথ্য এবং শিক্ষা জীবন:

প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ১৯১১ সালের ৫ মে চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার ধলঘাট ইউনিয়নের দক্ষিণ সমুরা গ্রামে বাবা জগদ্বন্দু ওয়াদ্দেদার এবং মাতা প্রতিভা দেবীর গৃহে এক ফুটফুটে রাজকন্যা হিসেবে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা ছিলেন তৎকালীন মিউনিসিপ্যাল অফিসের হেড কেরানি আর মা ছিলেন গৃহিনী। পরিবারে ছয় ভাই বোনের মধ্যে প্রীতিলতা ছিলেন দ্বিতীয়। তবে প্রীতিলতাকে মা প্রতিভাদেবী আদর করে ‘রানী’ বলে ডাকতেন। শিক্ষা জীবনের হাতেখড়ে হয় চট্টগ্রামের ডা. খাস্তগীর সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ে। ছাত্রী হিসেবে প্রীতিলতা খুব ভালো ফলাফল করার কারণে শিক্ষকদের নিকট খুবই প্রিয় ছিলেন এবং সবসময়ই সেরাদের তালিকায় থাকতেন। বড় বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন প্রীতিলতা। তিনি ঢাকা ইডেন কলেজ থেকে আইএ পরীক্ষায় মেয়েদের মধ্যে প্রথম এবং সম্মিলিতভাবে পঞ্চম স্থান লাভ করেন। এরপর কলকাতার বেথুন কলেজ থেকে ডিসটিংশান নিয়ে বিএ পাশ করেন তিনি।

মায়ের প্রতি তাঁর অগাধ ভালোবাসা:

যখন ১৯৩২ সালে পাহাড়তলীতে ইউরোপিয়ান ক্লাবে অভিযান চালানোর আগে তিনি তাঁর মাকে একটি চিঠি লিখেছিলেন, ‘মাগো, অমন করে কেঁদো না। আমি যে সত্যের জন্য, দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দিতে এসেছি। তুমি কি তাতে আনন্দ পাওনা মা? কী করব মা? দেশ যে পরাধীন। সমস্ত দেশবাসী বিদেশিদের অত্যাচারে জর্জরিত। তবে এখানে একটি ইন্টারেস্টিং তথ্য হলো, প্রীতিলতা ধীরে ধীরে বিপ্লবী হওয়ার বিষয়টি অবগত হওয়ার পর পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের এক ইন্সপেক্টর রীতিমতো হতবিহবল হয়ে বলেছিলেন, ‘এতো শান্তশিষ্ট মেয়ে ও, কত সুন্দর করে কথা বলতে পারে, ভাবতেও পারিনি তার ভেতর এত কিছু আছে! খুব সুকৌশলে আমাদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে সে পালিয়ে গেল।’

আজও স্মৃতিতে অম্লান প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার:

ব্রিটিশরা ১৯৪৭ সালে দেশ ত্যাগের পর তৎকালীন পাকিস্তার সরকার সেমিপাকা ঘরটিকে রেলওয়েকে হস্তান্তর করেন। তবে বর্তমানে চট্টগ্রাম রেলের পূর্বাঞ্চলের একটি বিভাগের প্রকৌশলীর দপ্তর হিসেবে পুরোনো ইউরোপিয়ান ক্লাবটি ব্যবহৃত হচ্ছে।

২০১২ সালের চট্টগ্রামবাসীর দাবির পপরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন ক্লাবের সামনের সড়কদ্বীপে ‘বীরকন্যা প্রীতিলতা’ ভাস্কর্য স্থাপন করেন। ব্রোঞ্জের তৈরি এ ভাস্কর্যটির নকশা প্রণয়ন করেন ভারতের বিখ্যাত ভাস্কর অধ্যাপক গৌতম পাল।

২০১৮ সালে এই ক্লাবটি ‘বীরকন্যা প্রীতিলতা জাদুঘর’ নামে পরিচিত পেলেও সেখানে কোনকিছুই সংরক্ষিত নেই। ২০২০ সালে কথা সাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্র‘ভালোবাসা প্রীতিলতা’ এর শ্যুটিংও এই ক্লাবটিতে হয়েছে।

বীরকন্যা প্রীতিলতার ৯৩ তম আত্মহুতি দিবস আজ-পরিশেষে:

দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য প্রতি বছর প্রীতিলতা ট্রাস্ট, পটিয়া গৌরব সংসদের উদ্যোগে প্রীতিলতার গ্রামের বাড়ির বাস্তুভিটায় তাঁর আবক্ষ মূর্তিতে শ্রদ্ধা নিবেদনসহ সামাজিক, সাংস্কৃতিক সহ নানা কর্মসূচি পালিত হয়ে থাকে। আজকের বীরকন্যা প্রীতিলতার ৯৩ তম আত্মহুতি দিবস আজ বিষয়ক ইতিহাস ভিত্তিক আর্টিকেলটি আশাকরি আপনার ভালো লেগেছে। এ রকম তথ্যমূলক আর্টিকেল পেতে আমাদেরকে কমেন্ট করতে পারেন।

আরও পড়ুন: দুর্গা পূজা ২০২৫: মা দুর্গার আগমন ও গমন হতে চলেছে কিসে

মূলত ডা. খাস্তগীর ইংলিশ হাইস্কুলে পড়ার সময় প্রীতিলতা বিপ্লবী ক্ষুদিরামের ফাঁসির কথা জানতে পারেন। এ ছাড়াও মাস্টারদা সূর্যসেনের সংগ্রামী জীবনের অনেক ঘটনা তাঁর কিশোরী মনেও রেখাপাত করেছিল। যাইহোক বীরকন্যা প্রীতিলতার ৯৩ তম আত্মহুতি দিবস আজ। অর্থাৎ আজ থেকে ৯৩ বছর আগের ঠিক আজকের তারিখেই দেশমাতৃকার স্বার্থে নিজের জীবন দিতেও এক মুহুর্তের জন্যও কুণ্ঠিত হননি। পরিশেষে আজকের বীরকন্যা প্রীতিলতার ৯৩ তম আত্মহুতি দিবস আজ বিষয়ক আলোচনায় আপনার দীর্ঘক্ষণ সম্পৃক্ত থাকার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।

এই পোস্টটি পরিচিতদের সাথে শেয়ার করুন

পূর্বের পোস্ট দেখুন পরবর্তী পোস্ট দেখুন
এই পোস্টে এখনো কেউ মন্তব্য করে নি
মন্তব্য করতে এখানে ক্লিক করুন

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।

comment url