সাবান কেমন করে তেল-ময়লা দূর করে
বর্তমানে আমাদের সকলেরই কাছে পরিস্কার এবং সাবান শব্দ দুটি অতি পরিচিত। আজকে সাবান কীভাবে তেল-ময়লা দূর করে সে বিষয়টা আমরা জানবো।
প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে সাবান দিয়ে হাত ও মুখ ধোয়া, গোসল করা, বাসন মাজা, কাপড় পরিস্কার সবক্ষেত্রেই সাবানের ব্যবহার অত্যধিক। কিন্তু সাবান কীভাবে তেল-ময়লা দূর করে সেটা জানাও আমাদের আগ্রহের মধ্যেই পড়ে। চলুন জেনে নিই-
পোস্ট সূচিপত্র: সাবান কেমন করে তেল-ময়লা দূর করে (How does soap remove oil and dirt?)
ভূমিকা:
যুগের পরিবর্তনে, সভ্যতার ছোঁয়ায় প্রাচীন থেকে বর্তমান অনেক কিছুরই রূপ, রস, গন্ধ, ধরণ, ব্যবহার, অভ্যাস ইত্যাদি নানা বিষয়ে পার্থক্য ঘটেছে। কিছুকাল পূর্বে যেমন মানুষ নদীতে গোসল করতে গেলে লাল মাটি খুঁজে তা মাথায় দিত মাথা ঘষার জন্য। (তবে এখনও অনেক আদিবাসীগণ তা ব্যবহার করে থাকে), আবার নদীর বালি দিয়ে দাঁত মাজা হতো, পরবর্তীতে তা কাঠ কয়লা বা গোবরের ছাইয়ে রূপান্তর লাভ করে। যাইহোক, এক সময় মানুষ সোডা দিয়ে কাপড় কাঁচাসহ তা দিয়ে মাথা ঘষতো।
আরও পড়ুন: হঠাৎ পেটে ব্যথা হলে কি করবো? ঘরোয়া উপায়ে পেট ব্যথা দূর করার
পরবর্তীতে কাপর কাঁচার জন্য ক্ষারযুক্ত সাবান, সার্প এক্সেল, সাবানের পাউডার, বিভিন্ন সুগন্ধি সাবান এবং পরিশেষে শ্যাম্পুর ব্যবহার। মোট কথা মানব সভ্যতার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আবিস্কার হলো এই সাবান। অর্থাৎ সাবান কীভাবে তেল-ময়লা দূর করে না বরং এটি আমাদের পরিচ্ছন্ন রাখতে, রোগব্যাধি থেকে রক্ষা করতে এবং সৌন্দর্য বৃদ্ধিতেও এই সাবান ব্যবহৃত হয়ে থাকে। সবথেকে বড় কথা কোভিড-১৯ থেকে আমরা অনেক বেশি সাবানের গুরুত্ব বুঝেছি।
কিভাবে সাবান তৈরি হয়:
সাবান তৈরির পদ্ধতিটা চমৎকার। মূলত সাবান তৈরি হয় তেল বা চর্বি থেকে। কিন্তু প্রশ্ন হলো শুধু তেল দিয়ে সাবান তৈরিতে কি লাভ? তাই এর জন্য প্রয়োজন একটি বিশেষ পদার্থ, যাকে বলা হয় লাই বা সোডিয়াম হাইড্রক্সাইড। মূলত লাই হলো খুব শক্তিশালী ক্ষার। আর এটি পানিকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। এর ভালোবাসার পরিমাণ এতো বেশি যে, তা পানির সঙ্গে মিশলে প্রচুর তাপ বের হয় এবং এর ফলে পানি গরম হয়ে যায়। আসলে লাই তেলের সঙ্গে বিক্রিয়া করলে ফ্যাটি অ্যাসিডগুলো গ্লিসারিন থেকে আলাদা হয়ে যায় এবং এই লাই এর সঙ্গে মিশে সাবান সোডিয়াম ষ্টিয়ারেট তৈরি করে। আর এর উপজাত হিসেবে তৈরি হয় গ্লিসারিন। অর্থাৎ এইভাবে তৈরি হওয়া সাবানে লাই-এর সোডিয়াম অংশটি ফ্যাটি অ্যাসিডের লম্বা কার্বন শিকলের সাথে যুক্ত হয়ে এর সোডিয়াম অংশটি হয়ে ওঠে পানি প্রেমী আর ফ্যাটি অ্যাসিডের অংশটি হয়ে ওঠে তেল প্রেমী।সাবানের বৈজ্ঞানিক নাম ও ব্যাখ্যা:
সাবানের রাসায়নিক নাম হলো সোডিয়াম স্টিয়ারেট। আর এটি এক ধরণের বিশেষ অণু, যা সাধারণ পদার্থের মতো নয়। মানুষের মধ্যে যেমন দ্বৈত বক্তিত্ব কাজ করে, ঠিক তেমনি সাবানেরও দুটি অংশ রয়েছে, অবশ্য সেগুলোর বৈশিষ্ট্য আলাদা। অর্থাৎ সাবানের যেমন একদিকে এমন এক অংশ রয়েছে যা প্রচন্ড পানি ভালোবাসে, যাকে বলা হয় হাইড্রোফিলিক আর অন্যদিকে রয়েছে লম্বা লেজের মতো অংশ যা তেল ও চর্বির সঙ্গে মিশতে পছন্দ করে এবং একে বলা হয় হাইড্রোফোবিক বা পানি বিদ্বেষী অংশ।সাবান কিভাবে আমাদের পরিস্কার করে:
খেয়াল করবেন, আমরা যদি কয়েকদিন গোসল না করি তাহলে শরীর থেকে দুর্গন্ধ বের হয়। কারণ কি? এর অন্যতম কারণ হচ্ছে কিছু ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ছত্রাক আমাদের শরীরের জৈব অণুগুলোকে ভেঙ্গে দুর্গন্ধের সৃষ্টি করে। আর এই জীবাণুগুলোর চারপাশে থাকে একটা সুরক্ষা স্তর। বলাবাহুল্য এই সুরক্ষা স্তরকে বলে মেমব্রেন। তবে এদের মধ্যে প্যাথোজেন নামে কিছু জীবাণু আছে, যেগুলো আমাদেরকে অসুস্থ্য করতে পারে। আসলে সাবান আর পানি আমাদের শরীরের এই মেমব্রেনগুলো ভেঙে জীবাণুগুলোকে মেরে ফেলে। আর তারপর পানি দিয়ে ধুয়ে নিলে সেই মরা জীবাণু আর গন্ধ ধুয়ে যায়। এক্ষেত্রে একটা বিষয় খেয়াল রাখবেন, যখন সাবান পানি দিয়ে হাত ধুবেন, তখন অন্তত ২০ সেকেন্ড ধরে হাত ধুতে হবে।আরও পড়ুন: রক্তের গ্রুপ কি পরিবর্তন হতে পারে
বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে সাবানের জগতেও সৃষ্টি হয়েছে নতুন নতুন উদ্ভাবনী বিষয়সমূহ। বর্তমানে এখন এমন ধরণের সাবান তৈরি হচ্ছে যা শুধুমাত্র পরিস্কারই করে না, বরং ত্বকেরও যত্ন নেয়া যায়। আবার বেশকিছু সাবানে সংযুক্ত করা হয়েছে প্রোবায়োটিকস, যা ত্বকের উপকারী ব্যাকটেরিয়াদের বৃদ্ধিতে সহায়তা করে থাকে। এ ছাড়াও এআই (আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্ট) এর যুগে কিছু সাবানে ন্যানো টেকনোলজি ব্যবহার করা হচ্ছে যাতে অতি সূক্ষ্মভাবেও ময়লা পরিস্কার করা যেতে পারে। আবার কিছু কিছু সাবান আছে যা ব্যবহার করলে তা পানিতে মিশে মাছ বা অন্যান্য জলজ প্রাণীর ক্ষতি করতে পারে। এ জন্য এখন বায়োডিগ্রেডেবল সাবান তৈরি হচ্ছে, যা প্রকৃতিতে সহজেই ভেঙে যায় এবং পরিবেশের কোনো ক্ষতি করতে না পারে।সাবান কেমন করে তেল-ময়লা দূর করে - পরিশেষে
সাবান আবিস্কার সুপ্রাচিনকাল থেকে না হলেও তা আমাদের আশর্ব্বাদ হিসেবেই ধরে নেয়া যায়। কেননা সাবান ব্যবহারে অনেক ব্যাকটেরিয়া, ছত্রাক, সংক্রামক রোগের জীবাণু ধ্বংস হয়ে যায়, যা শরীরের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। আজকের আর্টিকেলে সাবান কেমন করে তেল-ময়লা দূর করে তা আমরা জানতে পেরেছি। একটা বিষয় খেয়াল করবেন, আমাদের বাবা-দাদা-দাদু-দিদিমা যারা আমাদের বা আমার বংশের উত্তরসূরী তারা সাবান আবিস্কার না হওয়ার আগে কি করতো। অর্থাৎ উনারা টয়লেট করে মাটিতে বা বালু নিয়ে হাত ঘুষে ধুয়ে নিত এবং সেই হাত দিয়ে তারা আমাদের জন্য খাবারও তৈরি করতো। এখনও অনেক স্থান আছে যেখানে সভ্যতার আলো ঠিকমত পৌঁছায়নি, সেখানে তারা কিন্তু একই পদ্ধতি প্রয়োগ করে থাকে।অনেক অসুখ আছে, বিশেষ করে যাদের ডায়াবেটিস তাদেরতো খুব পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হয়। সাধারণত বর্ষাকালে পানিবাহিত অসুখগুলো বেশী হয়ে থাকে, যেমন-ডায়রিয়া, সর্দি-কাশি। আর বর্ষাকালে মাছির উপদ্রবও বেশী হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে আমরা যদি সচেতন না হয় বা পরিস্কার না থাকি, তাহলে গোটা পরিবারই পানিবাহিত রোগের প্রাদৃূর্ভাবে ভুগে থাকবে। অনেক ছোঁয়াচে রোগ আছে যার ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা দরকার এবং এক্ষেত্রে সাবান সেই সংক্রামক বা ছোঁয়াচে জীবাণুগুলো ধ্বংস করে দেয়। এক কথায় নিজেকে সুস্থ্য, পরিস্কার বা রোগ জীবাণু থেকে দূরে রাখতে হলে সাবানের কোন বিকল্প নেই। কারণ সাবানের মধ্যে যে দুই ধরণের উপাদান থাকে তাতে শরীর থেকে খুব অনায়াসেই জীবাণুগেুলো বেরিয়ে যেতে পারে।
আরও পড়ুন: লিউকেমিয়া: লক্ষণ, ঝুঁকি ও বিজ্ঞানীদের গবেষণা
পরিশেষে সাবান কেমন করে তেল-ময়লা দূর করে বিষয়ক আর্টিকেল থেকে যদি আপনার কিছু জানতে পারেন বা উপকৃত হতে পারেন, তাহলে আমাদের শ্রম স্বার্থক হবে বলে মনে করি। যদি কোন পরামর্শ বা উপদেশ থাকে তাহলে তা কমেন্টের মাধ্যমে জানাতে পারেন। আর দীর্ঘক্ষণ আমাদের সাবান কেমন করে তেল-ময়লা দূর করে বিষয়ে যুৃক্ত থাকার জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url