বিরল ধরণের অ্যালার্জি অ্যাফা-গ্যাল সিনড্রোম
পৃথিবীতে অনেক ধরনের অ্যালার্জিজনিত রোগ আছে, তার মধ্যে এই বিরল ধরণের অ্যালার্জি অ্যাফা-গ্যাল সিনড্রোম একটি অন্যতম।
লাল মাংস অর্থাৎ গরু, ছাগল বা হরিণের মাংস খেলেই শুরু হয়ে যাবে চুলকানি, বমি বমি ভাব, পেটব্যাথ্যাসহ জীবন সংকটজনক অ্যালার্জিক প্রতিক্রিয়া। বর্তমানে সারা বিশ্বে নতুন উদ্ভব এই বিরল ধরণের অ্যালার্জি অ্যাফা-গ্যাল সিনড্রোম, যার সম্পর্কে জানতে নিচের লেখাগুলো পড়ুন।
পোস্ট সূচিপত্র: বিরল ধরণের অ্যালার্জি অ্যাফা-গ্যাল সিনড্রোম (A rare type of allergy called Apha-Gal syndrome)
রোগের নামকরণ
এই অ্যালার্জির লক্ষণসমূহ
রোগের কারণসমুহ
গবেষণা সংস্থার তথ্য মতে
এজিএস-এর চিকিৎসা
কিভাবে প্রতিরোধ করা যেতে পারে
ঘরোয়া উপায়ে প্রতিরোধ করা
বিরল ধরণের অ্যালার্জি অ্যাফা-গ্যাল সিনড্রোম-পরিশেষে
রোগের নামকরণ:
এই রোগের নামকরণ দেয়া হয়েছে ‘অ্যাফা গ্যাল সিনড্রোম’ (Alpha-gal Syndrome বা সংক্ষেপে AGS)। মূলত এই রোগটি এক ধরণের কীট থেকে ছড়াচ্ছে, যারা কোন পশুকে কামড়ালে অর্থাৎ ‘লোন ষ্টার টিক (কীট)’ বা ‘ডিয়ার টিক (কীট)’ জাতীয় পোকা কামড়ানোর ফলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থায় এক ধরণের চিনিজাত অণুর প্রতি সংবেদনশীল হয়ে পড়ে।
আরও পড়ুন: চোখ চুলকানো একটি অস্বস্তি, কিভাবে সমাধান করা যায়
আর এই জাতীয় উপাদানগুলি থাকে স্তন্যপায়ী প্রাণীর মাংস ও দুগ্ধজাত পণ্যে। আসলে বণ্যপ্রাণীর শরীরে এই জাতীয় পোকা জন্মায়, যারা পশুর শরীরে পরজীবী হিসেবে বাধা বাধে এবং খুব তাড়াতাড়ি বংশবিস্তারও করে ফেলে। এরা পশুর শরীর থেকে মানুষের শরীরেও খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে পারে।
এই অ্যালার্জির লক্ষণসমূহ:
মূলত এই অ্যালার্জি এককজনের নিকট একেক রকম লক্ষণ হিসেবে দেখা দিয়ে থাকে। তবে সাধারণ লক্ষণগুলোর মধ্যে যেমন-সারা গায়ে চুলকানি, ঠোঁট ও চোখের পাতা ফুলে যাওয়া, শরীরের গ্রন্থিগুলো ফুলে লাল হয়ে ওঠা, হাঁচি, ভরাট নাক, গলা শক্ত হয়ে যাওয়া, শ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া, বমি হওয়া, রক্তচাপ কমে যাওয়া, মাথা ঘোরাসহ অজ্ঞান হয়ে যাওয়া। উপরোক্ত প্রতিক্রিয়াগুলো শুরু হয় খাবার খাওয়ার ২ থেকে ৬ ঘন্টা পরে। আর সে কারণে রোগী বা চিকিৎসক কেউই সহজে বুঝতে পারেন না এর মূল সমস্যার কারণসমূহ।
রোগের কারণসমুহ:
গবেষকরা জানিয়েছেন, এই রোগটি সাধারণ খাদ্য অ্যালার্জির মতো নয়। অর্থাৎ এটি সংক্রামিত হয় এক ধরণের কীট এর কামড়ের ফলে। মূলত ‘লোন ষ্টার টিক (কীট)’ এবং ‘ডিয়ার টিক (কীট)’ নামের কীট কামড়ালে শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থায় এক ধরনের চিনিজাত অণুর (গ্যালাকটোজ অ্যাফা-১ ও ৩-গ্যালাকটোজ, যা সংক্ষেপে অ্যাফা-গ্যাল) প্রতি সংবেদনশীল হয়ে পড়ে। আর এই উপাদানটি থাকে স্তন্যপায়ী প্রাণীর মাংসে এবং দুগ্ধজাত পণ্যে। অর্থাৎ এই টিক (কীট) গুলো কোন পশুকে কামড়ায়, ঠিক তার কিছু মাস পর, কেউ যদি ওই পশুর লাল মাংস বা দুগ্ধজাত খাবার গ্রহণ করে, তখন তার শরীরে অনায়াসে এই ভাইরাস প্রবেশ করে দেখা দেয় যত বিপত্তি।
গবেষণা সংস্থার তথ্য মতে:
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টারস ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ৪ লাখ ৫০ হাজার মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে বিশ্বব্যাপী এই সংখ্যা আরও বেশির আশঙ্কা করা হচ্ছে। কারণ এটা শুধু দক্ষিণ-পূর্ব যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, প্রতিনিয়তই বিশ্বের নানা অঞ্চলে তা ছড়িয়ে পড়ছে। ইতিমধ্যেই সার্বিয়ার একটি সংবাদ মাধ্যমে জানা গেছে, তাদের দেশটিতে প্রথমবারের মতো এই রোগ শনাক্ত হয়েছে।
এজিএস-এর চিকিৎসা:
আসলে বিরল ধরণের অ্যালার্জি অ্যাফা-গ্যাল সিনড্রোম সম্পর্কে বিশেষজ্ঞগণ বলেছেন, এই জাতীয় রোগ সম্পর্কে এখন পর্যন্ত চিকিৎসকদের মধ্যে সচেতনতার হার খুবই কম। ফলে সঠিক রোগ নির্ণয়ে অনেক সময় লেগে যাবে। এমনও হতে পারে, রোগী মাসের পর মাস ধরে ভুগতে বা চিকিৎসাসেবা নিতে থাকবেন, অথচ আসল কারণটাই অজানা থেকে যাবে তাদের কাছে। সবথেকে বড় বিষয় হলো যে, এই রোগের কোন প্রতিষেধক নেই।
কিভাবে প্রতিরোধ করা যেতে পারে:
চিকিৎসকদের মতামত হলো লাল মাংস, দুধ ও প্রাণীজাত উপাদান এড়িয়ে চলতে হবে। অর্থাৎ অ্যালার্জিজনিত সমস্যা একেক জনের একেক রকম হতে পারে। যেমন-কারো রেশমি কাপড়ে অ্যালার্জি হলে তিনি রেশমি কাপড় পড়বেন না। আবার কারো চিংড়ি মাষে অ্যালার্জি থাকতে তিনি চিংড়ি মাছ পরিহার করবেন। কারো ডাস্টে সমস্যা, তিনি হয় ডাস্ট এড়িয়ে চলবেন না মুখে মাস্ক ব্যবহার করবেন। তাই কোন বস্তুতে বা কোন উপাদানে অ্যালার্জি আছে তা সেই রোগী বা ভুক্তভোগীকেই ঠিক করতে হবে যে তিনি কিভাবে তার সমাধান করবেন।
ঘরোয়া উপায়ে প্রতিরোধ করা:
চোখের অ্যালার্জি: সাধারণত চোখের অ্যালার্জি সংঘটিত হলে নিম্নোক্ত কিছু ঘরোয়া পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে যারে:
চোখ অ্যালার্জিতে আক্রান্ত হলে ২ থেকে ৩ ফোটা গোলাপজল দিয়ে দিন। চোখে গোলাপজল দেয়ার পর আপনার চোখ কিছুক্সণ বন্ধ রাখতে হয়।
আরও পড়ুন: মধুর যত পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা
লবণপানি: চোখে অ্যালার্জিজনিত সমস্যায় ১ গ্লাস পানির মধ্যে ৩ চা-চামচ লবণ দিয়ে ভালো করে ফোটাতে হবে। এরপর তা পরিপূর্ণভাবে ঠান্ডা হয়ে গেলে পরিস্কার তুলা ভিজিয়ে চোখগুলো আস্তে ধীরে মুছে নিতে হবে। এতে করে চোখে থাকা ময়লা বেরিয়ে যাবে এবং সেইসঙ্গে চোকের জ্বালাপোড়া এবং চুরকানি থেকেও আরাম মিলবে।
ঠান্ডা পানি: চোখের অ্যালার্জির কারণে চোখ ফুলে গেলে, লাল হয়ে গেলে বা খুব চুলকালে সঙ্গে সঙ্গে ঠান্ডা পানির ঝাপটা দিন।
আমলকি ও মধু: অর্থাৎ শরীরের ইমিউন সিস্টেম বাড়াতে এবং শরীর অ্যালার্জি মুক্ত রাখতে আমলকী পাউডারের সঙ্গে মধু মিশ্রিত করে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে খেতে পারলে আপনার শরীরের ইমিউন সিস্টেমের উন্নতি ঘটবে।
পরিচ্ছন্নতা: চোখের অ্যালার্জিজনিত সমস্যায় পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা অত্যন্ত দরকার। কারণ চোখে ধুলাবালি না পড়ে সেজন্য সানগ্লাস ব্যবহার করতে হবে। আবার টিভি, মো্বাইল বা কম্পিউটারের সামনে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকা যাবেনা।
ঠান্ডা অ্যালার্জি: অনেকেরই ঠান্ডাজনিত অ্যালার্জি রয়েছে বা আছে। অর্থাৎ বিরল ধরণের অ্যালার্জি অ্যাফা-গ্যাল সিনড্রোম রোগে আক্রান্ত হলে ঠান্ডা অ্যালার্জিজনিত সমস্যা বাড়ে, তাই এক্ষেত্রে-
পেয়ারা: পেয়ারা খেতে পারেন, কারণ পেয়ারাতে ভিটামি সি রয়েছে। এ ছাড়াও লেবুর শরবত বা লেবু চা খেরেও উপকার পাবেন।
কালোজিরা: কালোজিরা ঠান্ডাজনিত অ্যালার্জি নিয়ন্ত্রণে রাখে। তাই রাত্রের খাবারে কালিজিরা ভর্তা বা ঘুমানোর আগে কালোজিরা বড়ি খেতে পারেন।
মধু: সাধারণত যাদের অ্যালার্জিজনিত ঠান্ডার সমস্যায় কষ্ট পাচ্ছেন, তাদের অন্তত দিনে দুই চা-চামচ মধু খেয়ে হবে।
বিরল ধরণের অ্যালার্জি অ্যাফা-গ্যাল সিনড্রোম-পরিশেষে:
আসলে বিরল ধরণের অ্যালার্জি অ্যাফা-গ্যাল সিনড্রোম রোগ থেকে অব্যাহতি পেতে অবশ্যই লাল মাংস পরিহার করতে হবে। অর্থাৎ গরু, ছাগল, মোষ বা হরিণের মাংস খাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। গবেষকগণ বলছেন, যদি একান্তই তা খেতে হয়, তাহলে উচ্চ তাপমাত্রায় মাংস সেদ্ধ করে তবেই তা গ্রহণ করা যেতে পারে। কারণ কাঁচা মাংস বা আধা কাঁচা মাংস খাওয়ার ফলেই এই পোকা মানুষের শরীরে বিরল ধরণের অ্যালার্জি অ্যাফা-গ্যাল সিনড্রোম খুব সহজেই মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে। এক্ষেত্রে সতর্কতা হিসেবে ফাস্টফুড জাতীয় খাদ্য যেমন-হট ডগ, বার্গার বা হ্যামবার্গার ইত্যাদি একেবারেই খাওয়া যাবে না।
আরও পড়ুন: কথা না বলে চুপ থাকাটা খুবই জরুরী
যাইহোক, সুস্থ্য দেহ সুস্থ্য মন সকলেরই প্রত্যাশা। তাই সবথেকে প্রয়োজন হলো সচেতনতা, তা যেমন নিজের জন্য জরুরী ঠিক তেমনি অপরের জন্যও জরুরী। ব্যাপারটা ঠিক এরকম, আমি জানলাম, কিন্তু অপরকে জানালাম না তা মনে হয় ঠিক নয়। সুতরাং আজকের বিরল ধরণের অ্যালার্জি অ্যাফা-গ্যাল সিনড্রোম বিষয়ক আর্টিকেল সম্পর্কে আপনাদের কোন মন্তব্য/পরামর্শ থাকে, তাহলে তা কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানাতে পারেন এবং আজকের আলোচনাটি আপনার নিকট গুরুত্বপূর্ণ মনে হলে তা অবশ্যই শেয়ার করতে পারেন। সবশেষে অ্যালার্জিজনিত রোগের বাহক অর্থাৎ বিরল ধরণের অ্যালার্জি অ্যাফা-গ্যাল সিনড্রোম বিষয়ক আলোচনায় আপনার দীর্ঘক্ষণ উপস্থিতির জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।
বি.দ্র.: উপরোক্ত আলোচনাটি সচেতনতার স্বার্থে প্রকাশিত, কোন ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন নয়। বিস্তারিত তথ্যের জন্য অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url