আমাদের জীবনে এমন কিছু পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, যেখানে কথা না বলে চুপ থাকাটা খুবই জরুরী হয়ে পড়ে।
মানুষ কথা না বললে মরে যাবে। অর্থাৎ কথাতো বলতেই হবে, তবে সেটা পরিবেশ-পরিস্থিতি বিচার বিশ্লেষণ করেই। প্রত্যেকটা মানুষের জীবনে এমন কিছু পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে, যার সমাপ্তি বা লাগাম টানতে কথা না বলে চুপ থাকাটা খুবই জরুরী বিষয় হয়ে দাঁড়ায়।
সারাবিশ্বে প্রতিনিয়তই বিভিন্ন দিবস পালিত হয়। আবার এই দিবসগুলির মধ্যে বেশকিছু অদ্ভুত দিবসও আছে, যেমন-ঘুম দিবস, ডিম দিবস, চকলেট দিবস ইত্যাদি। মজার বিষয় হলো উক্ত দিবসগুলোর মধ্যে আরও একটি দিবস আছে, সাইলেন্ট ডে বা নৈঃশব্দ্য দিবস। অর্থাৎ এই দিবসটিকে ‘চুপ থাকা দিবস’ হিসেবে অভিহিত করা হয়ে থাকে। মূলত এই দিনটিতে সবাইকে নিঃশব্দে এবং নিরিবিলি কোথাও কাটানোর প্রচেষ্টাকে উৎসাহিত করা হয়ে থাকে। বিজ্ঞানের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায় যে, চুপ করে থাকার উপকারিতা অনেক। কেননা এতে শরীর ভিতর থেকে তরতাজা হয়ে ওঠে এবং মানসিক চাপও কমে যায়। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও চুপ থাকার বিষয়ে অজস্র বর্ণনা ও মতামত প্রদর্শিত হয়েছে। যেমন-
প্রিয় নবী (সা.) বলেছেন, ‘যে চুপ থেকেছে, সে নাজাত পেয়েছে।’ (তিরমিজি)। আবার নবী (সা.) এও বলেছেন, ‘যে নিরাপদ থাকতে চায়, তা চুপ থাকা আবশ্যক।’ (মুসনাদ আনাস বিন মালিক, বায়হাকি)।
হজরত সুলায়মান(আঃ) বলেন, ‘যদি কথা বলা রৌপ্য হয়, তাহলে চুপ থাকা হলো স্বর্ণ’।
হজরত দাউদ(আঃ) বলেন, ‘আমি কথা বলে অনেক বার লজ্জিত হয়েছি। কিন্তু চুপ থকে কখনো লজ্জিত হইনি।’
শ্রীমদভগবত গীতায় চুপ থাকা নীরবতা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে। তাই গীতায় বলা হয়েছে, চুপ থাকার মাধ্যমে আত্ম-নিয়ন্ত্রণ ও মানসিক শান্তি লাভ করা যায়, সর্বোপরি তা আত্মার আধ্যাত্মিক উন্নতির জন্য সহায়ক। অর্থাৎ, চুপ থাকার মাধ্যমে মনে শান্তি ও নিয়ন্ত্রণ থাকে, অহংকার ও লোভ পরিহার করা যায় এবং কথা বলার ক্ষেত্রে সংযম ও কর্মের ফল আশা না করে প্রকৃত কাজ হচ্ছে কর্ম করে যাওয়া।
তাই, আজকে জেনে নিই কথা না বলে চুপ থাকাটা খুবই জরুরী বা প্রয়োজন বা কারণগুলি কি কি হতে পারে?
মস্তিষ্কে প্রশান্তি মেলে:
আসলে গবেষণা দ্বারা প্রমাণিত হয়েয়ে যে, প্রতিদিন যদি নিয়মানুযায়ী যোগ ব্যায়াম করা যায়, তাহলে মস্তিস্কে নতুন কোষের সৃষ্টি হয়। যার ফলে আমাদের স্মৃতিশক্তির উন্নতি ঘটে এবং তারই ফলশ্রুতিতে নতুন নতুন কিছু শেখার আগ্রহ বা ক্ষমতার বৃদ্ধি ঘটে।
গভীর নিদ্রাযাপন করা:
আসলে বেশী কথা বলার ফলে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয় যে, রাতে ঘুমেরই ব্যাঘাত ঘটে। তাই চুপ থাকা বা নীরবতা আমাদের ঘুমের সাইকেলকে স্বাভাবিক করে থাকে। এক্ষেত্রে যদি দিনে অন্তত কয়েক মিনিট মনস্তাত্ত্বিক ব্যায়াম অথবা মেডিটেশন করা যায়, তাহলে অনিদ্রা বা অবসাদ এবং ক্লান্তিও দূর হয়।
মানসিক প্রশান্তি:
সুস্থ্য থাকার জন্য অবশ্যই মানসিক প্রশান্তির প্রয়োজন। চলমান জীবনে মাত্রাতিরিক্ত শব্দদূষণ এবং বেশী কথা বলার কারণে আমাদের মস্তিস্ক বিচলিত অত্যধিক পরিমাণে বিচলিত হয়, যার প্রভাব পুরো শরীরের ওপরেই পড়ে। কিন্তু নৈঃশব্দ বা নিরিবিলি স্থান কিন্তু আমাদের মস্তিস্ককে শান্তি এনে দেয়, টেনশন দূর করে।
হার্টের স্বাস্থ্য ভালো থাকে:
প্রয়োজনের থেকেও বেশী কথা বলা বা চিৎকার-চেঁচামেচির অর্থ হার্টের ওপর চাপ প্রয়োগ করা। কারণ মস্তিস্ককে অত্যধিক চাপে রাখার কারণে তা শরীরের ওপর নানাভাবে প্রভাব বিস্তার করে এবং রক্তচাপও বেড়ে যায়।
তাই সুস্থ্যভাবে দীর্ঘদিন বাঁচতে চাইলে প্রতিদিন অন্ততপক্ষে ২ থেকে ৩ মিনিট নিরবতা বা চুপ থাকার চেষ্টা করতে হবে। কারণ চুপ থাকলে মানসিক স্থিরতা ফিরে আসে এবং সেইসঙ্গে মেন্টাল স্ট্রেসও কমতে শুরু করে।
মনোঃসংযোগ বৃদ্ধি:
আসলে বেশী কথার বলার কারনে অনেক কাজেই সঠিক মনোনিবেশ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনা। কারণ কথা ও কাজ দুটো একসঙ্গে করতে গেলে ভুল হতেই পারে। তাই স্বীয় দ্বায়িত্ব বা কাজ করার আগে কিছুক্ষণ নিরিবিলি বা চুপ থাকার পর যদি সে কাজটি শুরু করা যায়, তাহলে তার ফলাফল ভালো হয়।
শ্রবণের অভ্যাস গড়ে তোলা:
আসলে দুজনেই যদি একসাথে কথা বলে, তাহলে কে কার কথাটা শুনবে। এক্ষেত্রে বুদ্ধিমানের কাজ হলো, বেশী কথা না বলে শুনতে হবে ধৈর্য্য ধরে। অর্থাৎ কথা বলার থেকে কথা শোনাটাও একটি আর্ট। আবার অফিসের বস কোন বিষয়ে নির্দেশ দিচ্ছেন, সেক্ষেত্রে কেউ যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত প্রশ্ন করে, তাহলে ফলাফলটি নিশ্চয়ই আপনারা বুঝতে পারছেন।
কথা না বলে চুপ থাকাটা খুবই জরুরী-শেষ কথা:
তাহলে কথা না বলে চুপ থাকাটা খুবই জরুরী, কিন্তু সবক্ষেত্রে তা নয়। অর্থাৎ একেবারেই চুপ হয়ে যাওয়া বা কথা না বলা মানসিক স্বাস্থ্যেরই সমস্যা। তবে স্বল্পভাষী মানুষ কিন্তু অনেক জ্ঞানের পরিচায়ক। আমরা অনেক সময়ই বলে থাকি, কথা কম কাজ বেশি। কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে এই সচরাচর কথাটি আমাদের নিজেদের জীবনে কতটুকু প্রয়োগ ঘটায়। কথা না বলে চুপ থাকাটা খুবই জরুরী বিষয়ে একটি ঘটনার বিষয়ে আপনাদের অবহিত করি। বেশ অনেকদিন আগে উপমহাদেশের সকলের অত্যন্ত প্রিয় এবং সিনেমা জগতের জনপ্রিয় অভিনেতা অমিতাভ বচ্চনের একটি সাক্ষাৎকার দেখেছিলাম। সেখানে তিনি বর্ণনা করেছেন এভাবে-আমি একদিন বিদেশে কোন একটা কাজে প্লেনে যাচ্ছিলাম, তো সেই প্লেনে অনেক যাত্রী ছিল, সব যাত্রীই আমাকে চিন্তে পারায় তারা আমার কাছ থেকে অটোগ্রাফ নিচ্ছিল প্রতিনিয়তই। কিন্তু আমি লক্ষ্য করলাম, শুধুমাত্র একজন ব্যক্তি তাঁর কোন দিকে ভ্রূক্ষেপ নেই, কিছু কাগজপত্র ও পেপারের মধ্যেই তিনি ডুবে আছেন। আমার আগ্রহ ও কৌতুহল দুটোই বেড়ে গেল। আমি সেই ব্যক্তির নিকট গিয়ে, তাকে জিজ্ঞেস করলাম আপনি সিনেমা দেখেন না। তিনি উত্তর দিলেন, আমি খুব একটা সময় পাইনা। এরপর আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম, আমাকে চেনেন, আমার নাম অমিতাভ বচ্চন। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে আবার নিজের কাজে ডুবে গেলেন। আমার আগ্রহ ও কৌতুলের কারণে পরবর্তীতে আমি জেনেছিলাম, তিনি ছিলেন রতন টাটা। যারা দক্ষতা, বিচক্ষণতা ও নিরলস পরিশ্রশের সারা বিশ্বেই টাটা গাড়ী সমধিক পরিচিতি অর্জন করে।
যাইহোক, কথা না বলে চুপ থাকাটা খুবই জরুরী বিষয়ক আলোচনায় যদি আপনার কোন মন্তব্য/পরামর্শ থাকে তাহলে তা কমেন্টের মাধ্যমে আমাদের জানাতে পারেন। যে দেশ, যে জাতি কথা কম বলে নিজের কাজকে গুরুত্ব দিয়েছে, সে জাতি বা দেশ ততো উন্নত হয়েছে। সুতরাং কথা না বলে চুপ থাকাটা খুবই জরুরী বিষয়ক আলোচনাটি যদি আপনাদের ভালো লেগে থাকে তাহলে তা অবশ্যই শেয়ার করতে পারেন এবং দীর্ঘক্ষণ কথা না বলে চুপ থাকাটা খুবই জরুরী বিষয়ক আলোচনায় উপস্থিতির জন্য আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url