শুটকি মাছের উপকারিতা ও অপকারিতা
সাধারণত শুটকি মাছের উপকারিতা ও অপকারিতা কি বা এর কোন পুষ্টি গুণাবলীগুলি আছে কিনা, শুটকি মাছ খাওয়ার ক্ষেত্রে কোন সতর্কতাগুলি মেনে চলা উচিত অথবা শুটকি মাছ কিভাবে খাওয়া যেতে ইত্যাদি সমস্ত বিষয়ে জানতে নিচের লেখাগুলো অবশ্যই পড়তে হবে।
শুটকি মাছ আমাদের অনেকেরই নিকট একটি অতি প্রিয় খাদ্য এবং বলাবাহুল্য যে, শুটকি মাছ কিন্তু অনেক ভিটামিন সমৃদ্ধ একটি খাদ্যদ্রব্য।
পেজ সূচিপত্রঃ শুটকি মাছের উপকারিতা ও অপকারিতা
শুটকি মাছের উপকারিতা ও অপকারিতা
শুটকি মাছের পুষ্টি গুণাবলী
শুটকি মাছ খাওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা
শুটকি মাছ কিভাবে খাওয়া যেতে পারে
পরিশেষে
শুটকি মাছের উপকারিতা ও অপকারিতাঃ
শুটকি মাছের উপকারিতাঃ
শুটকি মাছ একটি উচ্চ প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবার। অর্থাৎ মানুষের শরীরের জন্য প্রোটিন প্রয়োজন, কারণ প্রোটিন আমাদের দেহের মাংসপেশী গঠন, ক্ষতিগ্রস্ত ত্বকে সহায়তা এবং ত্বক ও চুলের স্বাস্থ্য বজায় রাখে।
শুটকি মাছে প্রচুর আয়রন থাকায় তা শরীরের রক্তের হিমোগ্লোবিন তৈরিতে সহায়তা করে থাকে। কারণ শরীরে আয়রনের ঘাটতি হলে রক্তশূন্যতা বা অ্যানিমিয়া দেখা দিয়ে থাকে এবং তার ফলে ক্লান্তি, দুর্বলতা বোধ, শ্বাসকষ্ট ও মাথা ব্যথার কারণ হতে পারে।
আরও পড়ুন: ধুন্দলের উপকারিতা, ধুন্দল খাদ্য তালিকায় কেন রাখবেন
শুটকিতে ফসফরাস উপাদান থাকায় তা আমাদের শরীরের হাড়, দাঁত এবং ডিএনএ ও আরএনএ গঠনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। অর্থাৎ নিয়মিত শুঁটকি মাছ খেতে পারলে আমাদের শরীরে উপরোক্ত ভিটামিনগুলি যোগ হতে পারে।
সাধারণত শুটকি মাছে ভিটামিন-এ, ডি ও ভিটামিন-বি কমপ্লেক্স থাকে। এক্ষেত্রে যারা দৃষ্টিশক্তি সমস্যাসহ রাতের বেলা বা কম আলোতে দেখতে পাওয়া ব্যক্তিদের জন্য অত্যন্ত উপকারী ও সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। সর্বোপরি শুটকি মাছে ভিটামিন ডি শরীরের ক্যালসিয়াম তথা হাড় মজবুতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
শুটকি মাছের উপকারিতা ও অপকারিতা হিসেবে নিয়মিত শুটকি মাছ খেলে এতে থাকা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট উপাদান শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করে থাকে। এ ছাড়াও শুটকি মাছে থাকা ভিটামিন, মিনারেল এবং প্রোটিন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তা শরীর হতে বিভিন্ন সংক্রমনের ঝুঁকি কমায়।
শুটকিতে জিঙ্ক ও ম্যাগনেসিয়াম থাকায় তা রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। পাশাপাশি হরমোন ব্যালান্স ও ইনসুলিন নিয়ন্ত্রণ ও নার্ভের কার্যকারিতায় বিশেষ ভূমিকা পালন করে।
সাধারণত সামুদ্রিক বা লোনা পানির শুটকি মাছে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড পাওয়া যায়। যেমন-লইট্টা, চিংড়ি, রূপচাঁদা ইত্যাদি। এই ধরণের শুটকি মাছগুলো রক্তচাপ ও কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণসহ হৃদযন্ত্র, চোখ এবং মস্তিস্কের জন্য অত্যন্ত উপকারী।
শুটকি মাছে প্রাকৃতিক এনজাইম এবং প্রোটিন থাকে, যা পাচনতন্ত্রের জন্য খুবই উপকারী। তবে শুটকি মাছ খেলে তা পেটে হালকা অনুভূতি হতে পারে, তবে অতিরিক্ত গ্যাস বা ফোলাভাবের ঝুঁকি কিন্তু কমে। তাই যাদের হজমজনিত সমস্যা রয়েছে, তাদের ক্ষেত্রে শুটকি মাছ খাওয়া একটি ভালো দিক হতে পারে।
সাধারণত শুটকি মাছে প্রাকৃতিক লবণ এবং পটাশিয়াম থাকে, যা শরীরের ইলেক্ট্রোলাইট ভারসাম্য বজায় রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তবে লক্ষ্যণীয় বিষয় যে, যেহেতু শুটকি মাছে প্রাকৃতিক লবণ থাকে, সেক্ষেত্রে অতিরিক্ত লবণ যোগ করে শুটকি মাছ না খাওয়াই ভালো।
শুটকি মাছের অপকারিতাঃ
- সাধারণত শুটকি মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণে অনেক বেশি লবণ ব্যবহার করা হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে অতিরিক্ত লবণ উচ্চ রক্তচাপ এবং হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে।
- সাধারণত বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সঠিক স্বাস্থ্যবিধি না মেনে শুটকি মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ হয়ে থাকে, এতে করে বিভিন্ন কীটপতঙ্গ বা অন্যান্য প্রাণীর জীবাণু এর সাথে সম্পৃক্ততা হতে পারে।
- শুটকি মাছ প্রক্রিয়াকরণে অনেক সময় কীটনাশক বা রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়ে থাকে, যা স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত হুমকিস্বরূপ।
- সাধারণত শুটকি মাছ তাড়াতাড়ি শুকানোর জন্য কাঠ বা পলিথিন পোড়ানো ধোয়ায় শুকানো হয়ে থাকে, এতে করে কার্সিনোজেনিক অর্থাৎ ক্যানসারজনিত পদার্থ তাতে জমে থাকে।
- শুটকি মাছ ভালোভাবে সংরক্ষণ না করার ফরে তাতে ফাঙ্গাস বা ব্যাকটেরিয়া জন্মায়, যা খাদ্যবাহিত রোগ ঘটতে পারে।
- অনেক সময় বাসি বা পচা মাছ শুটকি করা হলে তা শরীরের জন্য ক্ষতিই বয়ে আনে।
- প্রচলিত পদ্ধতিতে মাছ আহরণের পর তা রোদে শুকানোর জন্য দেয়া হয়। কিন্তু মাছে থাকা কাদা, ধুলা-বালি, ময়লা প্রভৃতিসহ তা শুকানো হয়। যার কারণে তা শরীরের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
শুটকি মাছের পুষ্টি গুণাবলী:
নিম্নে ১০০ গ্রাম শুটকির আনুমানিক একটি পুষ্টি উপাদান যা ভাজা নয়, তুলে ধরা হল:
- প্রোটিন রয়েছে: ৫০-৭০ গ্রাম
- ফ্যাট পাওয়া যায়: ২-৬ গ্রাম
- ক্যালসিয়াম আছে: ৮০০-১২০০ মিলিগ্রাম
- ওমেগা-৩ রয়েছে ১-২ গ্রাম (অবশ্য সামুদ্রিক শুটকি মাছে)
- সোডিয়াম রয়েছে: ৫০০-৩০০০ মিলিগ্রাম (অবশ্যই প্রক্রিয়াকরণের উপর নির্ভর করে)
- শক্তি (ক্যালরি) রয়েছে: ২২০-৩০০ ক্যালরি
- আয়রন রয়েছে: ২-৫ মিলিগ্রাম
আরও পড়ুন: ছোট মাছ খেলে যেসব উপকার পাওয়া যায়
- এ ছাড়াও রয়েছে ভিটামিন-এ, ডি ও বি-কমপ্লেক্স, অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট, পটাশিয়াম, প্রাকৃতিক এনজাইম, ফসফরাস ইত্যাদি।
শুটকি মাছ খাওয়ার ক্ষেত্রে সতর্কতা:
- শুটকি মাছ ক্রয়ের ক্ষেত্রে দেখতে হবে যে সেটি ফরমালিন বা রাসায়নিকমুক্ত কিনা? অর্থাৎ এক্ষেত্রে যেসব এলাকায় শুটকি মাছ প্রক্রিয়াজাতকরণ হয়, যেমন-কক্সবাজার, সীতাকুন্ড এ রকম স্থান হতে ভালোমানের শুটকি ক্রয় করতে হবে।
- তবে শুটকি মাছ ভালো করে ধুয়ে নিয়ে তারপর সেটা যদি ভাজা করে রান্না করা হয়, তাহলে জীবাণু ও রাসায়নিকের প্রভাব কিছুটা হলেও কম হবে।
- প্রতিদিন শুটকি মাছ না খেয়ে সপ্তাহে ১ থেকে ২ বার শুটকি মাছ খাওয়া নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর।
শুটকি মাছ কিভাবে খাওয়া যেতে পারেঃ
শুটকি মাছের উপকারিতা ও অপকারিতা হিসেবে সাধারণত শুটকি মাছ বিভিন্ন রকমভাবে রান্না করে খাওয়া হয়ে থাকে। যেমন-বিভিন্ন তরকারির সাথে রান্না করে, ভর্তা হিসেবে আবার অনেকে এটি ভাজা করেও খেয়ে থাকে। তবে একান্তই বা সুনির্দিষ্ট করে জানার আগ্রহ প্রকাশ করেন, তাহলে অবশ্যই ইউটিউব থেকে বিভিন্ন রান্নার প্রক্রিয়াসমূহ দেখে নিতে পারেন। সুতরাং শুঁটকি মাছ রান্না বা কিভাবে খাওয়া যেতে পারে, যেমন-শুঁটকি মাছের মধ্যে শুকনা মরিচ, পেঁয়াজ কুচি কুচি করে দিয়ে এবং তার সাথে ধনে পাতা দিয়ে ভালো করে মেখে ভর্তা হিসেবে তা খেতে পারেন। আবার শুটকি মাছের সাথে বিভিন্ন রকম সবজি যেমন-বেগুন, আলু, টমেটো দিয়ে সুস্বাদু তরকারিও রান্না করতে পারেন। এ ছাড়াও শুঁটকি মাছের সাথে পেঁয়াজ, রসুন, মরিচ এবং অন্যান্য মসলা দিয়ে ভালো করে ভুনা তৈরি করেও তা খেতে পারেন। অনেক সময় আপনি ইচ্ছে করলে শুঁটকি মাছ ফ্রাই করেও খেতে পারেন, তবে এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, যে কোন শুঁটকি মাছই কিন্তু আপনি ফ্রাই করে খেতে পারবেন না বা ভালো লাগবে না। ফ্রাই করে খাওয়ার জন্য কিছু বিশেষ ধরনের শুঁটকি মাছ পাওয়া যায়, যেমন-লইট্টা ইত্যাদি। তবে খেয়াল রাখবেন, শুটকি মাছে অনেক সময় অতিরিক্ত লবণাক্ততা থাকে, তাই রান্নার করার আগে অবশ্যই গরম পানিতে ধুয়ে বা ভিজিয়ে রাখতে পারেন। আপনি ইচ্ছে করলে, এর থেকে হাড় এবং চামড়া ফেলে দিতে পারেন। অর্থাৎ এক্ষেত্রে ভিজিয়ে রেখে পরে সতর্কতার সাথে হাড়গুলো আলাদা করে ফেলে তা খুব সহজেই খেতে পারেন। তবে মনে রাখবেন শুঁটকি মাছ যদি সঠিকভাবে বা নিয়মানুযায়ী রান্না করতে পারেন, তাহলে এর প্রকৃত স্বাদ আপনি পেতে পারেন। কারণ অনেকেই আছে, যারা শুঁটকি মাছ ভালোভাবে রান্না করতে পারেন না, ফলে অনেক কষ্টে রান্না করার পরেও তা রুচিসম্মতভাবে খাওয়া হয়ে উঠেনা। প্রয়োজনে এক্ষেত্রে অভিজ্ঞদের পরামর্শ নিতে পারেন। বর্তমানে অনেক অঞ্চলে অবশ্য শুটকি মাছের সাথে অন্যান্য মাছ মিশ্রিত করে স্যুপ তৈরি করে খেয়ে থাকেন। আপনি জেনে অবাক হবেন যে, বর্তমানে বিশেষ করে জাপানে মাছের হাড় ও আঁশ প্রক্রিয়াজাত করে স্যুপ তৈরি করা হয়। যা অত্যন্ত স্বাস্থ্যসম্মত, সুস্বাদু এবং ভিটামিন সমৃদ্ধ।
শুটকি মাছের উপকারিতা ও অপকারিতা-পরিশেষেঃ
বিশেষজ্ঞদের মতে, যাদের দীর্ঘমেয়াদি কিডনি রোগজনিত সমস্যায় ভুগছে এবং যাদের শরীরে ইউরিক অ্যাসিড বাড়তি থাকে, তাদের অবশ্যই শুটকি মাছ খেতে নিষেধ করছেন। প্রকৃতপক্ষে শুটকি মাছের অনেক উপকারিতা ও গুণাগুণ আছে, তবে সেটা যদি সঠিক প্রক্রিয়াজাতকরণের মাধ্যমে হয়ে থাকে তাহলে সেটা অবশ্যই স্বাস্থ্যের জন্য সমিচীন।
আরও পড়ুন: জেনে নিন, দারুচিনির যত উপকারিতা ও পুষ্টিগুণ
যাইহোক আজকের শুটকি মাছের উপকারিতা ও অপকারিতা বিষয়ক আলোচনায় আপনি যদি কোন মন্তব্য/পরামর্শ প্রদান করতে চান, তাহলে কমেন্টের মাধ্যমে তা জানাতে পারেন। আমাদের প্রতিনিয়ত জীবন যুদ্ধে সঠিক ভাবে চলতে গেলে দরকার সচেতনতা, নিজেকে আত্মলোভী না করে দরকার সহনশীলতা। কেননা শুটকি মাছের যেমন হাজারো উপকারিতা রয়েছে তেমনি এর ক্ষতিকর দিকও অনেক। তাই জেনে-বুঝে বা ভালো মানের শুটকি খাওয়াটাই স্বাস্থ্যগত ভাবে ভালো থাকা। সবশেষে শুটকি মাছের উপকারিতা ও অপকারিতা বিষয়ক আলোচনায় আপনার দীর্ঘক্ষণ সম্পৃক্ততার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছি। যদি আজকের শুটকি মাছের বিভিন্ন বিষয়ের আলোচনা ও পরামর্শগুলি আপনার নিকট যুক্তিযুক্ত মনে হয়, তাহলে তা অন্যদের শেয়ার করতে পারেন।

এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url